বৃহস্পতিবার ২৭ নভেম্বর ২০২৫ - ২৩:১৩
১২ দিনের যুদ্ধে আমেরিকা-ইসরাইল পরাজিত হয়ে ‘খালি হাতে ফিরেছে’; ইরান প্রমাণ করেছে এটি দৃঢ় ইচ্ছা ও শক্তির কেন্দ্র

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইসরাইল পরিকল্পিত ১২ দিনের যুদ্ধ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং শত্রুপক্ষ কোনো লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই পরাজিত হয়ে ফিরেছে। তিনি বলেন, এই যুদ্ধে ইরানি জাতি ঐক্য ও দৃঢ়তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী ইসরাইল উভয়কেই পরাজিত করেছে—যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শত্রুর জন্য এক বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ পরাজয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ভাষণ দেন। তিনি ১২ দিনের যুদ্ধ এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন।

ভাষণে তিনি বলেন, দীর্ঘ দুই দশক ধরে ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে এমন একটি যুদ্ধ-পরিকল্পনা তৈরি করেছিল যার উদ্দেশ্য ছিল ইরানি জনগণকে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা এবং দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। “কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। যারা আগে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন তারাও এবার রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেশে সৃষ্টি হয়েছে সর্বজনীন ঐক্য।”

তিনি আরও বলেন, “তারা শত্রুতা নিয়ে এসেছিল, অশুভ উদ্দেশ্যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত চরম পরাজয়ের মুখে পড়ে খালি হাতে ফিরে গেছে। নিজেদের কোনো লক্ষ্যই তারা পূরণ করতে পারেনি—এটাই তাদের বাস্তব পরাজয়।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি’
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, আধুনিকতম আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র ব্যবহার করেও যুক্তরাষ্ট্র ইরানি জনগণকে নিজেদের পক্ষে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
“তাদের সমস্ত সামরিক সামর্থ্য ও গোয়েন্দা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। বরং জাতির ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং আমেরিকার পরিকল্পনাই তাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে,” মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি স্বীকার করেন যে, যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মে ইরানেও প্রাণহানি ঘটেছে। তবে তার মতে, “ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রমাণ করেছে যে এটি দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার কেন্দ্র—এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে এবং দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম।”

গাজায় গণহত্যা—ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী বদনাম
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনকে ইতিহাসের ভয়াবহতম ট্রাজেডির একটি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞের দায় ইসরাইলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়।
“ইহুদিবাদী ইসরাইল বিশ্বব্যাপী সম্মানহানি ও বদনামের শিকার হয়েছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্রও একইভাবে কুখ্যাত হয়েছে,” বলেন তিনি।

তার ব্যাখ্যা, বিশ্বের কাছে পরিষ্কার যে মার্কিন সামরিক সমর্থন ছাড়া ইসরাইল এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারত না।

বিশ্বব্যাপী সংকটের মূলে আমেরিকান নীতি
ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, “এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের উসকানির আগুন। যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন তিন দিনে যুদ্ধ শেষ করবেন, তিনি এখন ইউক্রেনের ওপর ২৮ দফা চাপিয়ে বসেছেন।”
তিনি আরও বলেন, লেবানন, সিরিয়া, পশ্চিম তীর এবং গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্পষ্ট; এটি তাদের ‘অপরাধী সমর্থনের’ প্রমাণ।

প্রতিরোধের সংস্কৃতি এখন আন্তর্জাতিক মাত্রায়
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ভাষ্যে, ইরানে গড়ে ওঠা প্রতিরোধের সংস্কৃতি আজ শুধু ফিলিস্তিন ও গাজায় নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, “প্রতিরোধের এই সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ন্যায় ও স্বাধীনতার আন্দোলনে নতুন প্রেরণা যোগাচ্ছে।”

সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান
দেশ পরিচালনা একটি কঠিন দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইরানের বর্তমান সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে, যার সুফল জনগণ শিগগির দেখবে। তাই তিনি জনগণকে প্রেসিডেন্ট ও সরকারের প্রতি সমর্থন বজায় রাখতে আহ্বান জানান।

বাসিজ বাহিনী—জাতীয় শক্তির ধারক
ভাষণে তিনি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন। বাসিজকে তিনি “ঐশী অনুপ্রেরণায় সজ্জিত, আত্মবিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক ও মূল্যবান জাতীয় আন্দোলন” হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, “চতুর্থ প্রজন্মের বাসিজ—আমাদের কিশোর-কিশোরীরা—আজ সেবা ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। এই আন্দোলনকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে।”

প্রতিরোধ, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিল্প, গবেষণা, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে যারা দেশকে সম্মানিত করছেন—সংগঠনভুক্ত হোক বা না হোক—তারা সকলেই বাসিজের মূল আদর্শ ধারণ করেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জনগণের প্রতি চার নির্দেশনা
বক্তৃতার শেষ অংশে তিনি ইরানি জনগণের প্রতি চারটি নির্দেশনা দেন—

১. সর্বজনীন ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা

২. প্রেসিডেন্ট ও সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা

৩. অর্থনীতিতে অপচয় পরিহার

৪. দোয়া, তওবা ও আল্লাহর প্রতি আস্থা বৃদ্ধি

তার মতে, “অপচয় কমতে পারলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং কল্যাণমূলক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha